নদ-নদী, খাল-বিল, অরণ্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বরিশাল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের অন্যতম জেলা। সতত গতি পরিবর্তনশীল এখানকার নদ-নদী ক্রমাগত ভাঙন ও ভূমিগঠনের কাজ করে চলেছে। তাই এই ভাঙা-গড়ার ভিতর এখানকার মানুষ নিয়ত সংগ্রামশীল। যুগ যুগ ধরে নানা দেশের নানা জাতির লোক এসে বসতি স্থাপন করে এ জেলার জনপদগুলিকে সমৃদ্ধ করেছে।
বরিশালের নামকরণ সম্পর্কে অনেক মতভেদ আছে। বড় বড় শালগাছের কারণে (বড়+শাল)= বরিশাল; পর্তুগীজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনীর জন্য বরিশাল; বড় বড় লবণের গোলার জন্য বরিশাল ইত্যাদি। গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। এ জেলার লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট' বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। বরিশালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টে ফরিদপুর ও খুলনা জেলাসহ বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফরিদপুর ও খুলনা জেলা বাদ দিয়ে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য, বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পীর ও মাওলানাদের প্রভাব: বরিশালের গ্রামাঞ্চলে পীর এবং মাওলানাদের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। সমগ্র জেলার অধিকাংশ গ্রামের লোকেরা কোনো না কোনো পীরের ভক্ত। কোনো মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য অনেকেই পীরের দরবারে মানত করে থাকে।
মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান: এ জেলার মুসলমানরা সাধারণভাবে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। তারা সকল প্রকার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে। পবিত্র রমজান মাসে অনেকেই একমাস রোজা রাখে। আবার অবস্থাপন্ন লোকদের মধ্যে অনেকেই পবিত্র হজও পালন করে।
গ্রামাঞ্চলের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই ছোট-বড় মসজিদ আছে। মসজিদগুলোয় প্রতি শুক্রবারে গ্রামের লোকজন একত্রে সমবেত হয়ে জুমার নামাজ আদায় করে।
ধর্মীয় উৎসব: মুসলমানরা বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর ও ঈদে মিলাদুন্নবী এই তিনটি ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাবেন। শহর ও গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে এ দিন তিনটি পালন করা হয়।
হিন্দু: সংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানদের পরেই এ জেলায় নমঃশূদ্র ও বর্ণহিন্দুদের স্থান। অতীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণহিন্দুদের সংখ্যাই ছিল বেশি। এদের জীবিকা ও কর্মসংস্থান সম্পর্কে জনসংখ্যা পরিসংখ্যানে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ শ্রেণীর লোকেরা বর্ণহিন্দু। এদের মধ্যে একমাত্র কায়স্থরাই কৃষিকর্মে নিয়োজিত ছিল। নিম্নবর্ণের মধ্যে নমঃশূদ্রের প্রাধান্যই ছিল বেশি।
খাদ্য: ভাত, মাছ, ডাল আর শাকসবজিই হচ্ছে এ জেলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রধান খাদ্য। হাঁস ও মুরগি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বিভিন্ন পার্বণে বা অতিথি আপ্যায়নে গ্রামের সাধারণ মানুষ গরু-হাঁস-মুরগির মাংস পরিবেশন করে থাকে। দুধ যদিও সকলের খুব প্রিয় তবু গরীব লোকেরা তা খুব কমই খেয়ে থাকে। গরীব লোকদের সাধারণ খাবার হচ্ছে মাছ-ভাত। গ্রামে যাদের মাছ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই, তারা খাল-বিল থেকে মাছ ধরে খায়।
খেলা-ধূলা: এ জেলায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, কাবাডি, ভলিবল ও হা-ডু-ডু এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলে ভলিবল ও ফুটবল খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। ইদানিং ক্রিকেট খেলাও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নদীতে অনেক সময় নৌকা-বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে প্রতিযোগিতার নৌকাগুলো মনোরম সাজে সজ্জিত করা হয়।
সংগীত এবং নৃত্য: ভাটিয়ালি, রাখালি, মুর্শিদি, জারি এবং সারি গান এ অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। যাত্রা, কবি-গান, নাটক এবং পুঁথি পাঠেরও প্রচলন দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীতেরও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে।
স্থাপত্য: বরিশাল জেলায় কিছু সংখ্যক প্রাচীন মসজিদ, মঠ ইত্যাদি স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন পাওয়া যায়। এ জেলার অনেক মসজিদের গঠন ও কারুকার্যের মধ্যে খানজাহান আলীর মসজিদের স্থাপত্যরীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জেলা গেজেটীয়ার: বাখরগঞ্জ, মে. জে. (অব.) এম এ লতিফ সম্পাদিত, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮৪।
তথ্য সংগ্রহ : বরিশাল জেলা তথ্য বাতায়ন